কল্পনা করুন, ভিনপাড়ার এক ব্যাটসম্যান খেলতে এসে বেদম পিটিয়ে নাস্তানাবুদ করলেন নিজেদের বোলারদের। সে ব্যাটসম্যান যখন আউট হচ্ছেন, তখন তাঁকে দুকথা না শুনিয়ে বাহবাও দিচ্ছেন পাড়ার সবাই! একটু অবাক হচ্ছেন, তা–ই না? হওয়ারই কথা। এ যেন গোটা পাড়া ভর্তি হয়ে গেছে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’-এ।
হ্যাঁ, ক্রিকেট বিশ্ব এমনই ঘটনা দেখল করাচিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে উসমান খাজা আজ ১৬০ রান করে আউট হয়েছেন। ৫৫৬ মিনিটের লড়াই শেষে যখন প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন, ঠিক তখন করাচি স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা দাঁড়িয়ে করতালিতে তাঁকে অভিবাদন জানান।
যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য মাঠ থেকে চূড়ান্ত সম্মানের প্রমাণ গ্যালারির দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানানো। আর সেটি যদি হয় প্রতিপক্ষের দর্শকদের কাছ থেকে, তবে তো ‘সোনায় সোহাগা’।
Standing ovation & loud chants of “Khawaja Khawaja” across NSK, excellent crowd for a test match in the heat but some tasubis & keyboard warriors on twitter will claim Karachi doesn’t turn up for cricket pic.twitter.com/ZZaIziujXw
— Osama. (@ashaqeens) March 13, 2022
পাকিস্তানে ২৪ বছর পর টেস্ট খেলতে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। সিরিজের প্রথম টেস্টে মাত্র ৩ রানের জন্য তিন অঙ্ক ছোঁয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় খাজার। জন্মস্থান ইসলামাবাদ থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব রাওয়ালপিন্ডিতে খেলতে নেমেছিলেন। জন্মভূমিতে খেলা প্রথম আন্তর্জাতিক ইনিংসটি তাঁর থামে ৯৭ রানে। তবে কঠোর অধ্যবসায়ে পরের টেস্টে, কার্যত পরের ইনিংসেই তিন অঙ্কের ছোঁয়া পেলেন। শতক তো পেলেনই, ইনিংসটি টেনে নিলেন ১৬০ রানে।
৩৬৯ বলের ইনিংসে ১৫ চার ও ১টি ছক্কা মেরেছেন। তবে চার-ছক্কার চেয়েও তাঁর ইনিংসের দৃঢ়তাই সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সাজিদ খানের দারুণ এক বলে বোল্ড হয়ে যখন প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা শুরু করলেন, ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছেন গ্যালারিভরা দর্শক। ‘খাজা, খাজা’ স্লোগান উঠল, অভিবাদনে ভাসলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার। অসাধারণ এক মুহূর্ত। শুধু একজন খেলোয়াড়কে নয়, ক্রিকেটের প্রতি পাকিস্তানি দর্শকদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এটি।
এজাজ প্যাটেলের কথা মনে আছে? গত ডিসেম্বরে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের বাঁহাতি এই স্পিনার। নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেললেও এজাজের জন্ম মুম্বাইয়ে। ৩৩ বছর বয়সে মাত্র ১১তম টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন নিজ জন্মভূমিতে। ভারতের বিপক্ষে মুম্বাইয়ের টেস্টে ইতিহাস গড়েন তিনি। মাত্র তৃতীয় বোলার হিসেবে প্রতিপক্ষের এক ইনিংসের সব উইকেট নিজের পকেটে পোরেন এজাজ।
এজাজের মতো বোলার নন খাজা, তাই উইকেটও নিতে পারবেন না। কিন্তু রান করে নায়ক হওয়ার তো সুযোগ আছেই খাজার। ৪ মার্চ ৩৫ বছর বয়সে নিজের জন্মভূমিতে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামার স্বপ্ন পূরণ হয় খাজার। আর সেই ম্যাচে অল্পের জন্য হাতছাড়া হওয়া সুযোগ দ্বিতীয় টেস্টেই পূর্ণ করেন খাজা। পাকিস্তানের মাটিতে ২৪ বছরে প্রথম কোনো অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে পাওয়া শতকটি খাজার ক্যারিয়ারের দশম।
গত বছর থেকেই তো পাকিস্তান সফর নিয়ে স্বপ্নাতুর ছিলেন খাজা। অস্ট্রেলিয়ার পাকিস্তান সফর নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা পালন করেন তিনি। গত বছর নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড নিরাপত্তা ইস্যুতে পাকিস্তানে সিরিজ বাতিল করায় কড়া সমালোচনা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ান সতীর্থরা যেন নিরাপত্তার অভাব বোধ না করেন, সেটা নিশ্চিত করে বলেছিলেন, ‘আমি ওদের (অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের) সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বলেছি, ডেভিড ওয়ার্নার, মারনাস লাবুশেন এবং স্টিভ স্মিথ—তোমাদের ওরা কখনো চোখের সামনে খেলতে দেখেনি। তোমাদের দেখে নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা অনুপ্রাণিত হবে।’
Day 2 saw the end of Khawaja’s batting masterclass, Carey missing out on a 💯, some clever wickets by 🇵🇰 and a special bowling cameo by @babarazam258. #BoysReadyHain l #PAKvAUS pic.twitter.com/cTRbExk8ty
— Pakistan Cricket (@TheRealPCB) March 13, 2022
দুই যুগ পর পাকিস্তান সফরে দারুণ ছন্দে থাকা খাজা এর চেয়ে ভালো সুযোগ কি আর কখনো পাবেন? নিশ্চয় চাইবেন, ইতিহাস তাঁকে মনে রাখুক। এজাজের মতো কোনো এক কীর্তি গড়বেন জন্মভূমিতে। সে পথেই আছেন খাজা। ইতিমধ্যে দুই ইনিংসে রান করেছেন ২৫৭। খাতা–কলমের হিসাবে সামনে আরও তিন ইনিংস খেলার সুযোগ আছে। সেটাকেই কাজে লাগাতে চাইবেন। আরও চাইবেন নতুন কোনো ইতিহাস গড়তে।
এমন কোনো কীর্তি হয়তো পাকিস্তান দলের জন্য কোনো সুখবর নয়। কিন্তু এতে কষ্ট পেলেও পাকিস্তানি দর্শকেরা যে খাজার কীর্তিকে সাধুবাদ জানাবেন; হয়তো এভাবে দাঁড়িয়ে, করতালিতে বা উল্লাসে, সেটা তো আজ জানিয়েই দিয়েছেন।